ভারতের ইতিহাস ও জনজীবনে হিমালয় পর্বত ও সমুদ্রের প্রভাব লেখাে।
■ প্রথম অংশ : ভারতের ইতিহাস ও জনজীবনে হিমালয় পর্বতের প্রভাব :
বিখ্যাত দার্শনিক বোদা মন্তব্য করেছেন, ভূগােল ও আবহাওয়া বিভিন্ন জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করে। সেই হিসাবে এদেশের জনজীবনে উত্তরে প্রায় ২,৫০০ কিলােমিটার স্থান জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নগাধিরাজ হিমালয়ের অপরিসীম প্রভাব রয়েছে, কারণ :
(১) হিমালয় পর্বত ভারতের উত্তর সীমান্তে দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতাে দণ্ডায়মান থেকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে এদেশকে রক্ষা করেছে।
(২) হিমালয় পর্বতের অবস্থান ভারতীয় উপমহাদেশকে মধ্য এশিয়ার হাড়কাঁপানাে ঠাণ্ডার হাত থেকে রক্ষা করেছে। হিমালয় পর্বত না থাকলে ভারতেও সাইবেরিয়ার মতাে তীব্র শৈত্যের প্রাবল্য দেখা যেত। অন্যদিকে হিমালয় পর্বতের সুউচ্চ প্রাচীরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতে বৃষ্টিপাত ঘটায়, যার ফলে ভারত হয়ে উঠেছে সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা।
(৩) সিন্ধু, গঙ্গা, ব্ৰত্মপুত্র প্রভৃতি উত্তর ভারতের প্রধান নদীগুলাের উৎস হল হিমালয়ের বিভিন্ন হিমবাহ। এছাড়া ভারতের অন্যান্য নদীগুলােও হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট। অন্যদিকে, ভারতের বিভিন্ন নদনদী হিমালয় পর্বত থেকে প্রচুর পরিমাণে পলি বয়ে এনে উত্তর ভারতের বিশাল সমভূমি অঞ্চলের সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীকালে যা ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়।
(8) ভারতের ইতিহাস ও জনজীবনে হিমালয় পর্বতের অপরিসীম প্রভাব রয়েছে, কারণ : হিমালয় যে দুর্জয় ব্যবধানের প্রাচীর গড়ে তুলেছে তার ফলে ভারত বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তােলার সুযােগ পেয়েছে।
৫) ভারতের ধর্ম, সভ্যতা এবং সংস্কৃতিতেও হিমালয় পর্বতের অপরিসীম প্রভাব রয়েছে। হিমালয় পর্বতের খাইবার, বােলান, গােমাল, জোজিলা, নাথুলা প্রভৃতি গিরিপথগুলাে দিয়ে যুগে যুগে আর্য, গ্রিক, শক, হুন, তুর্কি, মােগল প্রভৃতি জাতি ভারতবর্ষে প্রবেশ করে এই সভ্যতাকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
হিমালয়ে অবস্থিত এই সমস্ত গিরিপথগুলাে দিয়ে শুধুমাত্র বিদেশি যােদ্ধার দলই আসেনি—এসেছে ধর্মপ্রচারক, বণিক ও তীর্থ্যাত্রীর দল। হিমালয় পর্বতের উত্তর-পশ্চিমের খাইবার, বােলান প্রভৃতি গিরিপথ দিয়ে একদিকে প্রাচীন কালে আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে বৈদিক যুগের ভিত্তি রচনা করেছিল —অন্যদিকে, মধ্যযুগে এই একই গিরিপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে তুর্ক-আফগানও মােগলেরা প্রায় ১,০০০ বছর ধরে ভারতে ইসলামীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা করে ভারতের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছিল।
তাই বলা যায়, বহির্বিশ্বের সঙ্গে মৈত্রী ও সাংস্কৃতিক যােগাযােগের মাধ্যমে ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তনের ক্ষেত্রে হিমালয় পর্বত ও তার গিরিপথগুলাের প্রভাব অত্যন্ত বেশি।
■■ দ্বিতীয় অংশ : ভারতের ইতিহাসে সমুদ্রের প্রভাব : ভারতের ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে সমুদ্রের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে, যেমন :
(১) ভারতের তিন দিক, দক্ষিণ পশ্চিম ও দক্ষিণ পূর্ব সমুদ্র দ্বারা সুরক্ষিত হওয়ায় এদেশের উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলগুলি প্রাচীন কালে কোনাে বৈদেশিক আক্রমণে পড়েনি, বরং নিরাপত্তা রক্ষায় সাহায্য করেছে ।
(২) ভারতের দীর্ঘ উপকূলভাগের বেশিরভাগ অংশই সরল ও ঋজু হওয়ায় এখানে বেশি পােতাশ্রয় গড়ে ওঠেনি। যে কারণেই ভারতবাসী গ্রিক, পর্তুগিজ কিংবা স্পেনীয়দের মতাে সমুদ্রাশ্রয়ী জাতিতে পরিণত হয়নি।
৩) ভারতের অর্থনীতির মূল ভিত্তিই হল কৃষি। এদেশের কৃষি অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভরশীল ভারতমহাসাগর থেকে আগত মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের ওপর। কারণ এই মৌসুমি বায়ু দেশের মধ্যে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে কৃষি উৎপাদনে সাহায্য করে।
৪) ভারতের উপকূল সামুদ্রিক বন্দরগুলির মাধ্যমে প্রাচীনকাল থেকে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যােগসূত্র গড়ে উঠেছে। এমনকি সমুদ্রপথেই সুদূর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের পাশাপাশি ভারতীয় রাজারা উপনিবেশ স্থাপনে সক্ষম হন।
৫) ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমুদ্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য । দেশের বাণিজ্যিক আদানপ্রদান এর অধিকাংশই পরিচালিত হয় সমুদ্রপথে।
৬) পরবর্তী দিনে পাের্তুগিজ, দিনেমার, ইংরেজ, ফরাসি প্রভৃতি ইউরােপীয় জাতিগুলি সমুদ্রপথেই ভারতে প্রবেশ করে এবং উপনিবেশ গড়ে তােলে। অবশেষে ইংরেজ কোম্পানি ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হলে ভারতের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে।
■ উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বিশাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈচিত্র্যপূর্ণ ভৌগােলিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ভারতীয়দের চরিত্র, জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবিকা ও বৃত্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য পার্থক্যের সৃষ্টি করেছে।